সূরা আল-ফীল ( سُوْرَةُ الْفِيْلِ ) |
সূরা ফীল কুরআন মাজিদের ১০৫তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সূরাটিতে পাঁচটি আয়াত রয়েছে। ফীল অর্থ হাতি। এ সূরায় হস্তিবাহিনীর ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। ইয়েমেনের শাসক আবরাহা কাবা ঘরকে ধ্বংস করার জন্য হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করেছিল। আল্লাহ তা'আলা ছোট ছোট পাখির দ্বারা তাদের বাহিনীকে ধ্বংস করে ধুলায় মিশিয়ে দেন। সূরাটিতে হস্তিবাহিনীর এ করুণ পরিণতির কথা বর্ণিত হয়েছে বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে সূরা ফীল।
শানে নুযুল
ইয়েমেনের রাজা ছিল জুনুওয়াস। সে ছিল ইহুদি। খ্রিস্টানদের সে অকথ্য নির্যাতন করত। তাদের জোর করে ইহুদি ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত। এমনকি সে ইনজিলের কপি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তখন রোমের বাদশাহ আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশিকে জুনুওয়াসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। নাজ্জাশি তখন আবরাহা নামক এক ব্যক্তিকে এক বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ জুনুওয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আবরাহা জুনুওয়াসকে ধ্বংস করে এবং ইয়েমেনের ক্ষমতা দখল করে নেয়।
ইয়েমেনের অধিপতি হয়ে আবরাহা দেখল আরব, ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশের জনগণ মক্কায় অবস্থিত কাবা প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে কাবাকে তাওয়াফ করে, সম্মান ও ভক্তি করে। তাই কাবার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা যাতে কমে যায়, পৃথিবীর মানুষ যেন কাবার কাছে না যায়, সে জন্য সে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তখন সে ইয়েমেনের রাজধানী সান'আ শহরে একটি সুন্দর ও বহু মণিমুক্তা খচিত গির্জা তৈরি করল। মানুষকে সে এ গির্জায় হাজির হতে নির্দেশ দিল এবং মক্কায় কাবা শরিফে না যাওয়ার জন্য তাগিদ দিল। কিন্তু তার শত চেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থ হলো। কেউ তার গির্জায় যেতে রাজি হলো না। সে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এরই মধ্যে আরবের কোনো এক ব্যক্তি গোপনে ঐ গির্জায় প্রবেশ করে সেখানে মলত্যাগ করে রাখে। এরপর কে বা কারা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন আবরাহা রাগে ও ক্ষোভে কাবা ঘর ভেঙে ফেলার জন্য ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে এক বিশাল হস্তি বাহিনী নিয়ে অভিযান শুরু করে। এ বাহিনীতে বিপুল সৈন্য ও তেরোটি বিশালাকায় শক্তিশালী হাতি ছিল। পথিমধ্যে আরবের যে গোত্রই তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, সে তাদেরকে ধ্বংস করে সামনে অগ্রসর হয়। তখন কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মহানবি (সা.)-এর দাদা কুরাইশ নেতা আবদুল মুত্তালিব। আবরাহার সৈন্যরা মক্কাবাসীদের উটগুলো নিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে আবদুল মুত্তালিবের দুইশ উটও ছিল। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, তোমার সৈন্যবাহিনী আমাদের উটগুলো আটক করেছে, সেগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করো। এতে আবরাহা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। সে বলল, আমি তোমাদের কাবা ঘর ভেঙে ফেলার জন্য এসেছি, কিন্তু তোমরা সে ব্যাপারে কোনো কথা না বলে তোমাদের উটের কথা বলছ। তখন আবদুল মুত্তালিব বললেন, 'আমি উটের মালিক, তাই উটের কথা বলছি আর কাবা ঘরের মালিক মহান আল্লাহ, তিনি তা অবশ্যই রক্ষা করবেন।' এ কথা শুনে আবরাহা কিছুক্ষণ নীরব থেকে উটগুলো ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিল। আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। সকলে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিল। পরদিন সকালে আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে হাতিগুলো সামনে অগ্রসর হতে পারল না। এ সময় মহান আল্লাহ সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ ও হলুদ রঙের অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি প্রেরণ করেন। এরা দুই পায়ে দুটি এবং ঠোঁটে একটি করে ক্ষুদ্র কংকর নিয়ে এসে আবরাহার সৈন্যবাহিনীর উপরে নিক্ষেপ করল। ফলে আবরাহার সৈন্যবাহিনী ক্ষণিকের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল। আর আবরাহা আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল। তার সমস্ত শরীরে বসন্তের দাগের ন্যায় জখম হয়ে গেল। তার দেহ পচে রক্ত ও পুঁজ বের হতে লাগল। অতিশয় কষ্টের পর সে মারা গেল। এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর ঘরকে আবরাহার ধ্বংসের পরিকল্পনা থেকে রক্ষা করেন। উক্ত প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা'আলা সূরা ফীল নাযিল করেন এবং বিশেষ ঘটনা জগৎবাসীকে জানিয়ে দেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। |
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحْبِ الْفِيلِ
| ১. আপনি কি দেখেননি, আপনার প্রতিপালক হস্তিবাহিনীর সঙ্গে কীরূপ আচরণ করেছিলেন? |
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ | ২. তিনি কি তাদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? |
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيْلَ 8 | ৩. আর তিনি তাদের প্রতি ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি প্রেরণ করেন। |
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيلٍ
| ৪. সেগুলো তাদের উপর কংকর- জাতীয় পাথর নিক্ষেপ করে। |
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ 6
| ৫. অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণসম করেন। |
ব্যাখ্যা
এ সূরায় ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের ব্যর্থ চেষ্টা নস্যাৎ করার ঐতিহাসিক ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। এটি মহান আল্লাহর কুদরত ও হিকমতের অপূর্ব নিদর্শন। মহানবি (সা.)- এর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে ঘটনাটি ঘটে। আবরাহা অনেক ধন-সম্পদ ও সৈন্য-সামন্তের মালিক ছিল। তার বিশাল হস্তিবাহিনী ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতার তুলনায় এসব সম্পদ ও সৈন্য-সামন্ত অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। আল্লাহ তা'আলা মহাপরাক্রমশালী ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতে পারেন।
আবরাহা ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়েছিল। গর্ব ও অহংকারবশত মহান আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা করেছিল। মহান আল্লাহ তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখির সাহায্যে ধ্বংস করে দেন। এ ঘটনায় বুঝা যায় যে, যারা আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানি করবে, ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা করবে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াতেও তাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহাকে তার সৈন্য ও হস্তি বাহিনীসহ ক্ষণিকের মধ্যে ধ্বংস করে দিয়ে মহান আল্লাহ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ব্যক্তি, সমাজ, জাতি যে-ই ইসলামের ক্ষতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হবে, দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না। শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও তারা মহান আল্লাহর ভয়াবহ আযাব থেকে রেহাই পাবে না।
শিক্ষা এ সূরা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই- ১. কাবা মহান আল্লাহর ঘর, আর এটি সংরক্ষণ তিনিই করবেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি এটি ধ্বংস করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না। ২. মহান আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতা অসীম। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাঁর মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়। ৩. যারাই মহান আল্লাহর নাফরমানি করবে, তিনি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন। ৪. আল্লাহদ্রোহী ও নাফরমানদের শাস্তি শুধু পরকালেই হবে, তা নয় বরং দুনিয়াতেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। ৫. ইসলামের বিরুদ্ধে কাফির-মুশরিকদের সমস্ত কৌশল ও ষড়যন্ত্র মহান আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। কেননা তিনিই সর্বোত্তম কৌশলী। |
common.read_more